
কে এই মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ? ইরানের রাজনীতিতে কেন তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ!
ইরানের প্রসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করার পর আগামী ২৮ জুন ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর এতে অন্যান্য প্রার্থীদের সাথে নির্বাচনের ঘোষনা দিয়েছেন দেশটির সাবেক প্রসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ।সম্প্রতি একটি ভিডিও বার্তায় আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন ইরানের এই সাবেক প্রসিডেন্ট। একই সাথে দেশটির জনগণ অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাবে বলেও জানান তিনি।
তার এই ঘোষনার ফলে ইরান জুড়ে তাকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। শুধু ইরান নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও শুরু হয়েছে নানা গুন্জন। তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কি কি পরিবর্তন আসতে পারে তা নিয়েও চলছে চুল ছেড়া বিশ্লেষন। বিশ্লষকদের মতে তিনি ইরানের রাজনীতিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাদের অন্যতম একজন, তাছাড়া ইরানের বর্তমান সংসদেও মাহমুদ আহমেদিনেজাদ এর বেশকিছু সমর্থক রয়েছে, যারা এরই মধ্যে মাহমুদ আহমেদিনেজাদের নির্বাচনে প্রতিদন্ধিতার ঘোষনাকে স্বাগত জানিয়েছে।
কে এই মাহমুদ আহমেদিনেজাদ
মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ২৮ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে ইরানের গার্মসারে জন্মগ্রহণ করেন। আহমেদিনেজাদের পিতা একজন লোহার কারিগর এবং ধর্মপ্রাণ শিয়া মুসলিম ছিলেন। পরিবারটি মূলত ইরানের আরদেবিল প্রদেশ থেকে তেহরানে চলে আসে। তিনি তেহরান ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
আহমেদিনেজাদ একজন ধর্মপ্রাণ শিয়া মুসলিম এবং তার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ তার রাজনৈতিক জীবনে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি বেশ কিছু বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন, যা ইরানের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় বিষয়াবলী নিয়ে লেখা।
আহমেদিনেজাদ ১৯৯৩ সালে আরদাবিল প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন। পরে তিনি তেহরানের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (২০০৩-২০০৫)। ২০০৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হন। ২০০৯ সালের নির্বাচনেও পুনরায় জয়ী হন, যদিও এই নির্বাচন ব্যাপক বিতর্কিত ছিল এবং বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিল।
প্রথম মেয়াদে (২০০৫-২০০৯), তিনি দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেন। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির সংস্কারমুখী নীতি থেকে সরে এসে কট্টর ইসলামী নীতি পুনঃপ্রবর্তন করেন। আহমেদিনেজাদের শাসনামলে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করে, যা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করে এবং ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইসরায়েলকে মুছে ফেলার আহ্বান এবং হলোকাস্ট নিয়ে সংশয় প্রকাশের কারণে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচিত হন।
দ্বিতীয় মেয়াদ (২০০৯-২০১৩) ২০০৯ সালের পুনঃনির্বাচন ব্যাপক বিতর্কিত ছিল এবং এতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এর ফলে দেশব্যাপী বড় ধরনের বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যা “গ্রিন মুভমেন্ট” নামে পরিচিত। দ্বিতীয় মেয়াদে ইরান ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, যার মূল কারণ ছিল আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও তার প্রশাসনের কিছু ভুল নীতি। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।তার প্রশাসনের শেষ দিকে, আহমেদিনেজাদ এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং অন্যান্য রক্ষণশীলদের মধ্যে বিরোধ তীব্র হয়।
আহমেদিনেজাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ভর্তুকি সংস্কার এবং বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করেন। তবে তার অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করেন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের তীব্রতা বৃদ্ধি করেন। তার সময়ে ইরান-আমেরিকা সম্পর্ক বিশেষভাবে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। আহমেদিনেজাদ তার কঠোর ইসলামী মূল্যবোধ প্রচার এবং নারীদের পোশাকের বিষয়ে কঠোর নিয়ম আরোপ করেন।
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল তার প্রার্থীতা বাতিল করে। এই পদক্ষেপটি ইরানের রাজনৈতিক শীর্ষ স্তরের মধ্যে তার জনপ্রিয়তার হ্রাস নির্দেশ করে। আহমেদিনেজাদ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হন। তিনি রাজনৈতিক ভাষণ প্রদান এবং ইরানের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের উপর মতামত প্রদান করেন।
মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবেন। তার শাসনামল ইরানের নীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং তার বিভিন্ন কর্ম এবং বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়েছে।
ইরানের রাজনীতিতে মাহমুদ আহমেদিনেজাদ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ইরানের রাজনীতিতে বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ছিলেন। তার শাসনামল এবং রাজনৈতিক কৌশল ইরানের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
আহমেদিনেজাদ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ব্যাপকভাবে জোরদার করেন। তার শাসনামলে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রচেষ্টা তীব্র করে, যা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করে এবং ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ হয়। এ পদক্ষেপ ইরানের বৈদেশিক নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দেয়।
আহমেদিনেজাদ অর্থনৈতিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেন এবং তার সরকার ভর্তুকি সংস্কারের মাধ্যমে আর্থিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করে। তবে তার অর্থনৈতিক নীতির ফলে ইরানে মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, যা সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে।
আহমেদিনেজাদ তার কঠোর ইসলামী মূল্যবোধের প্রচার করেন। তার শাসনামলে নারীদের পোশাকের ব্যাপারে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয় এবং ইসলামী শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের প্রতি জোর দেয়া হয়। এটি ইরানের সামাজিক কাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে।
২০০৯ সালের পুনঃনির্বাচনের পর ব্যাপক বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের সৃষ্টি হয়, যা “গ্রিন মুভমেন্ট” নামে পরিচিত। এই আন্দোলন ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি আহমেদিনেজাদের শাসনামলে সাধারণ জনগণের অসন্তোষকে তুলে ধরে।
আহমেদিনেজাদের বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্য, যেমন ইসরায়েলকে মুছে ফেলার আহ্বান এবং হলোকাস্ট নিয়ে সংশয় প্রকাশ, আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এবং সমালোচনার সৃষ্টি করে। এর ফলে ইরানের বিদেশ নীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং ইরান আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তার দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিকে, আহমেদিনেজাদ এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং অন্যান্য রক্ষণশীলদের মধ্যে বিরোধ তীব্র হয়। এটি ইরানের শীর্ষ রাজনীতিকদের মধ্যে মতভেদের একটি প্রতিফলন এবং ইরানের রাজনৈতিক কাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
তার শাসনামলে ইরানের ওপর কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরান অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে এবং জনগণের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে।
মাহমুদ আহমেদিনেজাদের শাসনামল ইরানের রাজনীতিতে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। তার কর্মকাণ্ড এবং নীতি ইরানের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং তিনি ইরানের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হবেন।