ইব্রাহিম রাইসি’র জীবনী
আন্তর্জাতিক

ইব্রাহিম রাইসি’র জীবনী

--
মে ২৩, ২০২৪

ইরানের রাষ্ট্রপতি এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পথ:

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন ইরানের রাষ্ট্রপতি, ইসলামী প্রজাতন্ত্রে প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলের ধারাবাহিকতা এবং পরিবর্তন উভয়েরই প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৬০ সালে মাশহাদে জন্মগ্রহণ করেন, রাইসি’র ক্ষমতার উত্থানে ইরানের বিচার ব্যবস্থায় তার দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি’র সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সাথে গভীরভাবে জড়িত।

প্রারম্ভিক জীবন এবং শিক্ষা:

অষ্টম শিয়া ইমাম ইমাম রেজার মাজারের আবাসস্থল, ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর মাশহাদে রাইসির  প্রাথমিক শিক্ষা এবং আদর্শিক গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অল্প বয়স থেকেই তিনি ধর্মীয় অধ্যয়ন চালিয়েছিলেন, কওমের সেমিনারে যোগদান করেছিলেন, যেখানে তিনি বিশিষ্ট আলেমদের অধীনে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং ইসলামের শিক্ষা এবং ইরানী বিপ্লবের নীতিগুলিতে নিজেকে নিমজ্জিত করেছিলেন।

বিচারিক পেশা:

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর রাইসির বিচারিক কর্মজীবন শুরু হয়। কয়েক দশক ধরে তিনি ইরানের বিচার বিভাগের মধ্যে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, একজন কট্টর রক্ষণশীল এবং কট্টরপন্থী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার ভূমিকার মধ্যে রয়েছে উপ-প্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সাধারণ পরিদর্শন সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। তার মেয়াদকে ইসলামী আইনের কঠোর ব্যাখ্যা এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। রাইসির কর্মজীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত পর্বগুলির মধ্যে একটি ছিল ১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক বন্দীদের গণহত্যার সাথে তার জড়িত থাকার অভিযোগ, এই সময়কালকে সমালোচকরা “মৃত্যু কমিশন” হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যদিও রাইসি সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন, পর্বটি তার রেকর্ডে একটি উল্লেখযোগ্য দাগ এবং মানবাধিকার আইনজীবীদের উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রয়ে গেছে। এত কিছুর পরও বলা যায় যে, রাইসি ইরানের বিচারিক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিচার ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নতির জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা: 

নির্বাচনী রাজনীতিতে রাইসির যাত্রা শুরু হয়েছিল তার ২০১৭ সালের রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনের মাধ্যমে, যেখানে তিনি নিজেকে দরিদ্রদের একজন চ্যাম্পিয়ন এবং দুর্নীতির বিরোধী হিসাবে অবস্থান করেছিলেন। যদিও তিনি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কাছে হেরেছেন, রাইসির প্রচারণা ইরানের রক্ষণশীল শিবিরে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার মর্যাদাকে দৃঢ় করেছে। ২০১৯ সালে রাইসিকে সর্বোচ্চ নেতা খামেনেই বিচার বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেছিলেন, ইরানের ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে তার প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তার মেয়াদে উচ্চ-মানের দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা দেখা গেছে, যা জনসংখ্যার কিছু অংশের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও অন্যরা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসাবে দেখেছে। রাইসি একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ইরানের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের অবস্থান শক্তিশালী করে করছেন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দিয়েছেন।

প্রেসিডেন্সি: 

২০২১ সালে রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাইসির নির্বাচন কম ভোটার উপস্থিতি এবং নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল, যা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের ব্যাপক হতাশা প্রতিফলিত করে। তার বিজয়কে মূলত রক্ষণশীল সংস্থার দ্বারা ক্ষমতার একত্রীকরণ হিসাবে দেখা হয়েছিল, রাইসি আদর্শিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে, রাইসি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।  বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরতা কমাতে এবং দেশীয় উৎপাদনকে জোরদার করার লক্ষ্যে রাইসি একটি “প্রতিরোধী অর্থনীতির” মাধ্যমে অর্থনৈতিক কষ্ট মোকাবেলা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। 

যাইহোক, এই প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণ করার জন্য তার প্রশাসনের ক্ষমতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক ফ্রন্টে রাইসির রাষ্ট্রপতিত্ব, পশ্চিমের সাথে ইরানের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দেখা দেয়, বিশেষ করে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি সম্পর্কে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (JCPOA) নামে পরিচিত। যদিও রাইসি আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তিনি পূর্বশর্ত হিসাবে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার উপর জোর দিয়েছেন, এমন একটি অবস্থা যা কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে জটিল করে ফেলেছিল। 

আদর্শগত অবস্থান এবং দৃষ্টিভঙ্গি: 

আদর্শগতভাবে রাইসি সর্বোচ্চ নেতা খামেনির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সারিবদ্ধ হন, তিনি একটি ধর্মতান্ত্রিক শাসন প্রনালির পক্ষে সমর্থন করেন যা ইসলামী নীতি এবং বিপ্লবী আদর্শকে প্রাধান্য দেয়। তিনি ইরানের রক্ষণশীল জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সাথে সুর মিলিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ন্যায্যতা এবং পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উপর জোর দেন । যাইহোক, রাইসির কট্টরপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবাধিকার রেকর্ড ইরানের বৈশ্বিক অবস্থানের উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য বাধা সৃষ্টি করে। তার রাষ্ট্রপতিত্ব সম্ভবত মতাদর্শগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখা এবং ইরানি জনগণের বাস্তবসম্মত চাহিদা পূরণের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখেছে।

ইসলামী আইন ও বিচারশাস্ত্র:

রাইসি একজন প্রখ্যাত ইসলামী আইনজীবী এবং বিচারক। তিনি ইসলামী আইন ও বিচারশাস্ত্র নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন এবং এই বিষয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান করেছেন। তাঁর চিন্তায় ইসলামী আইন শাস্ত্রের বিভিন্ন দিক বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে, যেমন শরিয়া আইন, ফিকাহ ও উসুল আল-ফিকাহ।

ইসলামী নৈতিকতা ও সমাজ ব্যবস্থা:

রাইসির ইসলামী চিন্তায় নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ইসলামী সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ ও নৈতিক আচরণের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব।

শিক্ষা ও গবেষণা:

ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে রাইসি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করেছেন এবং ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রমকে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছেন।

ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু:

১৯ মে ২০২৪ তরিখে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ান এবং তাদের সঙ্গে থাকা অন্য আরোহীরা মারা গেছেন।পূর্ব আজারবাইজানের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের ভারজাকান অঞ্চলে ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। 

ইতিকথা: 

ইব্রাহিম রাইসির রাষ্ট্রপতি পদে আরোহণ ইরানের রাজনৈতিক বিবর্তনে একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিচার বিভাগীয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গভীরভাবে তার কর্মজীবন দেশের ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে রক্ষণশীল উপাদানগুলির স্থায়ী প্রভাবের উপর জোর দেয়। ইরান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং জটিল আন্তর্জাতিক গতিশীলতার সাথে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাইসির ভূমিকা অপরিসীম।তাছাড়া ইব্রাহিম রাইসির ইসলামী চিন্তা ও অবদান সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, বলা যায় যে তিনি ইসলামী মূল্যবোধ ও আইনশাস্ত্রের প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন এবং ইরানের রাজনৈতিক ও বিচারিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *