আজ বিকাল ৪টায় বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার এক মাস পর দেশে ফিরেছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকেরা। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় নোঙর করে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছয়টায়, কুতুবদিয়ায় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ থেকে নেমে এমভি জাহান মণি-৩ লাইটার জাহাজে করে আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে পৌঁছেছেন নাবিকেরা।

স্বজনেরা জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর নাবিকদের কাছে পাওয়ার অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। যন্ত্রনাদায়ক অপেক্ষার অবসান হলো আজ। কেউ হাতে ফুল, কেউবা কেক নিয়ে নাবিকদের স্বজনেরা বন্দর জেটিতে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সোমালিয়ার দস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাস পার হলেও এত দিন নাবিকদের দেখা পাননি স্বজনেরা। জাহাজটি আরব আমিরাত ঘুরে চট্টগ্রামে আসার পর প্রথমবার স্বজনদের সাথে নাবিকদের দেখা হয়। এসময় কোন কোন নাবিককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। কারো বাবা-মা, কারো ছেলে-মেয়ে আবার কারো ভাই-বোন অপেক্ষায় ছিলেন জেটি চত্তরে।
অন্যান্যদের মত জেটি চত্বরে ছিলেন ছেলে ও এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদের মা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে। সোমালিয়ায় জিম্মি হওয়ার পর ছেলের জন্য অসম্ভব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। দুই মাসের বেশি সময় যে কীভাবে কেটেছে, তা বলে বুঝানো যাবেনা। আজ ছেলেকে কাছে পাব, এর চেয়ে আনন্দের কী হতে পারে।
জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খানের দুই মেয়ে বলেন, বাবা আসবেন, এ জন্য ছুটে এসেছি । তাঁরা বলেন, বাবাকে কাছে পাব, এটা ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে। আমাদের আজ অনেক অনেক আনন্দের দিন।
জেটি চত্বরে অপেক্ষায় আছেন লক্ষ্মীপুর থেকে আসা ওমর ফারুক তিনি নাবিক আইয়ুব খানের ভাই । তিনি জানান, অনেক চিন্তায় ছিলাম ভাইয়ের জন্য। জলদস্যুদের কাছ থেকে কবে মুক্ত হয়ে দেশে আসবে, এজন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এখন ভাই দেশে এসেছে, চিন্তা দূর হয়েছে। অনেক ভাল লাগা কাজ করছে নিজের মধ্যে। স্বস্তি এসেছে পরিবারের সবার মধ্যে।
দেশে ফিরে আসা একজন নাবিক বলছিলেন “ অনেক অপেক্ষা ছিলাম এই দিনটার জন্য । পরিবারের কাছে ফিরতে পারবো কি না এ শঙ্কায়ও ছিলাম। অবশেষে দেশে ফিরলাম। মনে হচ্ছে আমি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি।”
দস্যুরা কিভাবে পাহারা দিতো তা বলতে গিয়ে একজন নাবিক বলেন, বন্দিদশার প্রথম কয়েক দিন ভয়াবহ অবস্থায় ছিলেন তারা।
তিনি বলেন, “শুরুর দিকে আমরা ব্রিজে অবস্থান করতাম। তারা সবসময় ভারী অস্ত্র নিয়ে আমাদের পাহারা দিতো।
তারা যাতে খারাপ ব্যবহার না করে সেজন্য আমরা তাদের সাথে খুবই ভালো আচরণ করি। একটা সময় দস্যুরা আমাদের সাথে একটু সহজ হলেও সবসময় পাহারা দিতো” ।
“জীবনে এটা একটা খারাপ সময়। পুরাটা মাস ছিল বিভীষিকায় । দ্রুত শেষ হয়েছে এজন্য স্বস্তি। ওই দিন আর মনে করতে চাই না ” বলেন জিম্মি-দশা থেকে মুক্ত নাবিকদের একজন।
নাবিক আজিজ বলেন, “যেহেতু এই কোম্পানির একটা জাহাজ আগে এরকম পরিস্থিতি থেকে তিন মাসে মুক্ত হয়েছিল। তাই একটা সময় আমার মনেও ভরসা জাগে। একমাসেই আমাদের মুক্ত করা হয়েছে সে জন্য জাহাজ কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ”।
ভাইকে বরণ করে নেয়ার পর ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের বড় ভাই ওমর ফারুক বলেন, “এ ধরনের পরিস্থিতিতে এই প্রথম পড়েছিলাম আমরা।
আর কারো পরিবার যাতে এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি না হয়। রোজার ঈদ করতে পারি নি। আমাদের পরিবারের জন্য আজ ঈদের দিন”।
নাবিকদের বরণ করে নিতে বন্দর জেটিতে ছিলেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, এ সময় কেএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সরওয়ার জাহান রোকন, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম।
কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘আমাদের ভাইয়েরা আমাদের কাছে ফিরে এসেছেন, এমুহুর্তে এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে। জিম্মি হওয়ার পর থেকে মুক্তি পাওয়া এবং দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাই সবার কাছে, সকল মহলের আন্তরিক চেষ্টায় জলদস্যুদের কাছ থেকে মক্ত করে নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
এমভি আবদুল্লাহ বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় নোঙর করে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায়। জাহাজটির ড্রাফট বেশি হওয়ায় (সাড়ে ১২ মিটার) তা বন্দর জেটিতে ভেড়ানোর সুযোগ ছিলনা। এ কারণে তীর থেকে নৌযানে করে সাগরে নোঙর করে রাখা এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটিতে উঠে নতুন করে ২৩ জন নাবিক যোগদান করেন। নতুন নাবিকদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন জিম্মিদশা থেকে মুক্ত নাবিকেরা। এরপর মুক্ত নাবিকেরা ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা কেএসআরএম গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি-৩ এ করে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে পৌঁছান।
গত মার্চ মাসের ১২ তারিখ ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার জলদস্যুরা কেএসআরএম গ্রুপের এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ছিনতাই করেছিল। ৩৩ দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি মুক্ত করা হয়। এরপর জাহাজটি প্রথমে আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছে সেখানে পণ্য খালাস শেষে আমিরেতের আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে চট্টগ্রাম বন্দরের পথে রওনা হয়েছিল। ১৩ দিনের মাথায় জাহাজটি বাংলাদেশের জলসীমায় এসে পৌঁছাল।
মুক্ত নাবিকেরা হলেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ, প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান, দ্বিতীয় কর্মকর্তা মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, তৃতীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম সাইদুজ্জামান, দ্বিতীয় প্রকৌশলী তৌফিকুল ইসলাম, তৃতীয় প্রকৌশলী মো. রুকন উদ্দিন, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান ও চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসেন।
জাহাজের অপর নাবিকেরা হলেন ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ, মো. সাজ্জাদ হোসেন, মো. আনওয়ারুল হক, মো. আসিফ উর রহিম, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, মো. শফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ নুর উদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, আইনুল ইসলাম, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মোহাম্মদ সালেহ আহমেদ।