ইসলামের দৃষ্টিতে শুক্রবারের তাৎপর্য
ধর্ম শিক্ষা

ইসলামের দৃষ্টিতে শুক্রবারের তাৎপর্য

মে ২৪, ২০২৪

ইসলামে শুক্রবারকে বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রদান করা হয়েছে। আরবি ভাষায় এ দিনটিকে “ইয়াওমুল জুমু’আ” বলা হয়। শুক্রবারের এই তাৎপর্য কুরআন, হাদিস এবং ইসলামী ঐতিহ্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। নিচে তা ধারাবাহিক আলোচনা করা হলো:-

কুরআনের আলোকে:

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে শুক্রবারের গুরুত্বের উল্লেখ করেছেন। সূরা আল-জুমুআ (সূরা ৬২) আয়াত ৯-১১ এ বলা হয়েছে: “হে মুমিনগণ, যখন শুক্রবারের নামাযের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে।”

এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে, জুমুআর নামাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এ নামাজের আহ্বানের পর যাবতীয় কার্যকলাপ বন্ধ করে নামাজে অংশগ্রহণ করা উচিত।

হাদিসের আলোকে:

হাদিসেও শুক্রবারের বিশেষ তাৎপর্য বিবৃত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“সপ্তাহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন হল শুক্রবার। এ দিন আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এ দিনই তাকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।” (মুসলিম)

“যে ব্যক্তি জুমার দিন ভালো করে গোসল করল, দ্রুততর সময়ে মসজিদে গেল ও (ইমামের) কাছাকাছি বসে মনোযোগসহ (খুতবা) শুনল, তাঁর জন্য প্রতি কদমের বদলে এক বছরের রোজা ও নামাজের সওয়াব থাকবে”। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৫)।

আধ্যাত্মিক দিক:

শুক্রবার মুসলিমদের আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি বিশেষ দিন। এ দিনটিতে বিশেষ কিছু ইবাদতের মাধ্যমে মুমিনরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করেন। শুক্রবারের ফজিলত ও বরকতের কারণে এ দিনটিকে অধিক পরিমাণে ইবাদত ও দোয়ার মাধ্যমে পার করা হয়।

গুনাহ মাফ:

শুক্রবারে ছোট গুনাহ মাফ হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জুমুআর দিনে গোসল করা, মসজিদে গিয়ে খুতবা শোনা এবং নামাজ আদায় করার মাধ্যমে এ সপ্তাহের ছোট গুনাহগুলো মাফ হয়ে যায়।” (বুখারি, মুসলিম)

ঐতিহাসিক দিক:

ইসলামী ইতিহাসে শুক্রবারের বিভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক দিন হিসেবে পরিচিত। ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে সংঘটিত হয়েছে, যেমন:

আদম (আ.) এর সৃষ্টি: ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ আদম (আ.) কে শুক্রবারের দিন সৃষ্টি করেছেন।

জান্নাতে প্রবেশ ও বেরিয়ে আসা: আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) কে জান্নাতে প্রবেশ করানো এবং পরে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল শুক্রবারের দিন।

অন্যান্য আমল:

শুক্রবারের দিনে বিশেষ কিছু আমল করা সুন্নত হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মধ্যে কয়েকটি হল:

মিসওয়াক করা: হাদিসে এসেছে, “জুমুআর দিনে গোসল করা এবং মিসওয়াক করা সুন্নত।” (মুসলিম)

সুন্দর পোশাক পরা: রাসূলুল্লাহ (সা.) শুক্রবারে পরিষ্কার ও সুন্দর পোশাক পরতে উৎসাহিত করেছেন।

সুরমা ব্যবহার করা: হাদিসে এসেছে, “শুক্রবারের দিনে সুরমা ব্যবহার করা সুন্নত।” (আবু দাউদ)

দান-সদকা:

শুক্রবারের দিনে দান-সদকা করা অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ হিসেবে গণ্য হয়। এই দিনে দান করলে আল্লাহ তায়ালা বেশি সাওয়াব দান করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “শুক্রবারের দিনে দান-সদকা করলে আল্লাহ তাতে দ্বিগুণ সাওয়াব দান করেন।” (তিরমিজি)

শবে জুমুআর গুরুত্ব:

শুক্রবারের রাত, যাকে শবে জুমুআ বলা হয়, এটিও গুরুত্বপূর্ণ। এ রাতে ইবাদত করা ও দোয়া করার ফজিলত রয়েছে। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি শবে জুমুআতে কুরআন তিলাওয়াত করে, তার জন্য একটি নূর আলোকিত হয়।” (বাইহাকি)

শুক্রবারের নামাজ ও খুতবা:

জুমুআর নামাজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে না থাকলেও, এটি ফরজে আইন (প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মুসলিমের জন্য আবশ্যক) হিসেবে গণ্য হয়। এ নামাজ দুই রাকাতের হয়ে থাকে এবং এর পূর্বে ইমাম খুতবা প্রদান করেন। ইমাম খুতবার সময় বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা করেন, যা মুসলিম সমাজের নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। খুতবার মাধ্যমে মুসলিমরা ইসলামের নীতি-আদর্শ সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে তা প্রয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়। খুতবাতে ইমাম ইসলামিক শিক্ষা ও নীতি-আদর্শের উপর আলোকপাত করে বলেই এটি মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষ আমল:

শুক্রবারের বিশেষ কিছু আমল রয়েছে যেগুলো মুসলিমরা পালন করে থাকেন:

সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করা: হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি শুক্রবারের দিন সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করে, তার জন্য দুটি জুমুআর মধ্যে একটি নূর আলোকিত হবে।” (বাইহাকি)

দরুদ পাঠ করা: শুক্রবারে অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করা সুন্নত হিসেবে বিবেচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের জুমুআর দিনগুলোতে আমার উপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করো, কেননা তোমাদের দরুদ আমার কাছে উপস্থাপন করা হয়।” (আবু দাউদ)

মাগফিরাত ও দোয়া কবুলের সময়:

শুক্রবারে এমন একটি সময় রয়েছে যখন আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তা কবুল হয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “জুমুআর দিনে একটি সময় রয়েছে, যখন কোন মুসলমান বান্দা আল্লাহর কাছে কোন কল্যাণের দোয়া করলে, আল্লাহ তা কবুল করেন।” (বুখারি, মুসলিম)

ইসলামী ঐতিহ্য ও সমাজে শুক্রবারের প্রভাব:

ইসলামি সমাজে শুক্রবারের দিনটি সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোর তুলনায় আলাদা গুরুত্বের অধিকারী। এ দিনটিতে মুসলিমরা একত্রিত হয়ে জুমুআর নামাজ আদায় করে, যা সামাজিক সংহতি ও ঐক্যের প্রতীক। শুক্রবারের জুমুআর নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে মুসলিমরা একত্রিত হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করেন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত করেন। এ দিনটি পরিবার ও সমাজের সদস্যদের সাথে সময় কাটানোর এবং তাদের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।

ইতিকথা:

শুক্রবার ইসলামী সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এ দিনটি মুসলিমদের জন্য শুধুমাত্র ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, সামাজিক ও পারিবারিক দিক থেকেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে এ দিনটির পূর্ণাঙ্গতা ও বরকত লাভের জন্য মুসলিমদের উচিত আল্লাহর ইবাদত করা, পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা এবং সমাজে শান্তি ও কল্যাণ ছড়িয়ে দেয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *