বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা
শিক্ষা সর্বশেষ

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা

মে ২৮, ২০২৪

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, তার বিশাল জনসংখ্যার জন্য শিক্ষা একটি প্রধান অগ্রাধিকার। বিগত কয়েক দশকে দেশের শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি থেকে শুরু করে নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে, যা সবার জন্য সমান ও উচ্চমানের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমাধান করা প্রয়োজন।

ঐতিহাসিক পরিচয়

বাংলাদেশের শিক্ষার ঐতিহাসিক পথ একটি দীর্ঘ এবং অর্থবহ ইতিহাসের মধ্যদিয়ে বর্তমান অবস্থানে এসেছে। প্রাচীন সময়ে বৌদ্ধ মঠ এবং ইসলামী মাদ্রাসাই শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র ছিল। কলনিক শাসনকালে বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষা আরম্ভ হয়,  ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজি শাসকরা ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশে স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে শিক্ষায় উন্নতির প্রতি নতুন আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতি লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গঠন

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রধানত চারটি স্তরে বিভক্ত: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক এবং বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। মাধ্যমিক শিক্ষা ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত, যা মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ হয়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী নিয়ে গঠিত, যা উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। উচ্চ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির মাধ্যমে প্রদান করা হয়, যেখানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত।

শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন

১. ভর্তির হার বৃদ্ধি: বাংলাদেশ প্রায় সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করেছে। ইউনেস্কোর মতে, প্রাথমিক শিক্ষায় নিট ভর্তির হার সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ৯৮% এ পৌঁছেছে।

২. লিঙ্গ সমতা: নারী শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে লিঙ্গ সমতা অর্জিত হয়েছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদের ভর্তি সংখ্যা ছেলেদের থেকেও বেশি।

৩. সাক্ষরতার হার: সাক্ষরতার হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, ১৫ বছর এবং তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৪.৭% ছিল, যা ২০০০ সালের প্রথম দিকে প্রায় ৫০% ছিল।

৪. উচ্চ শিক্ষার সম্প্রসারণ: সরকারি ও বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশের অনেক শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ বেড়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ

১. শিক্ষার গুণগত মান: উচ্চ ভর্তির হার সত্ত্বেও, শিক্ষার গুণগত মান একটি বড় উদ্বেগ। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রম উন্নয়ন এবং শ্রেণীকক্ষের সম্পদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতির প্রয়োজন।

২. ঝরে পড়ার হার: প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হার বেশি হলেও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়েছে। অর্থনৈতিক কারণ, বাল্যবিবাহ এবং শিক্ষার প্রতি আগ্রহের অভাব এই প্রবণতায় অবদান রাখে।

৩. অবকাঠামো এবং সম্পদ: অনেক স্কুলে, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। শ্রেণীকক্ষ অতিরিক্ত ভিড়যুক্ত এবং শিক্ষাদানের উপকরণ এবং সঠিক স্যানিটেশন সুবিধার ঘাটতি রয়েছে।

৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়ন: শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন অপরিহার্য। তবে, বাংলাদেশে অনেক শিক্ষক যথাযথ প্রশিক্ষণ পান না এবং চলমান পেশাগত উন্নয়নের সুযোগের অভাব রয়েছে।

৫. সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সমান শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, যার মধ্যে প্রতিবন্ধী শিশু, আদিবাসী সম্প্রদায় এবং দূরবর্তী অঞ্চলের শিশু অন্তর্ভুক্তি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই বৈষম্যগুলি মোকাবেলা করার প্রচেষ্টা চলছে তবে আরও মনোযোগ প্রয়োজন।

৬. পাঠ্যক্রম এবং মূল্যায়ন: বর্তমান পাঠ্যক্রমটি আধুনিক শিক্ষার অনুশীলন এবং শ্রম বাজারের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উপরন্তু, মূল্যায়ন ব্যবস্থা কঠিনভাবে পরীক্ষাভিত্তিক, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার সীমাবদ্ধ করতে পারে।

৭. শৈশবকালীন শিক্ষা: শৈশবকালীন শিক্ষা জ্ঞানীয় এবং সামাজিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য, তবুও এটি অনেক এলাকায় অপর্যাপ্ত। গুণগতমানের শৈশবকালীন কার্যক্রমগুলিতে প্রবেশাধিকার বাড়ানো প্রয়োজনীয়।

সরকারি উদ্যোগ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

শিক্ষাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে:

১. শিক্ষা নীতি ২০১০: এই সামগ্রিক নীতিটি শিক্ষা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে। এতে গুণগতমানের উন্নয়ন, পাঠ্যক্রম সংস্কার এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের উপর জোর দেয়া হয়েছে।

২. প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (PEDP): PEDP একটি বৃহৎ পরিসরের কর্মসূচি যা প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, ভর্তির হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়ার হার হ্রাসের উপর কেন্দ্রীভূত। 

৩. বৃত্তি কর্মসূচি: নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন বৃত্তি কর্মসূচি রয়েছে, যা তাদের স্কুলে থাকতে এবং তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করতে উৎসাহিত করে।

৪. ডিজিটাল শিক্ষা: সরকার “ডিজিটাল বাংলাদেশ” উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। এর মধ্যে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ প্রদান এবং শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মধ্যে আইসিটি দক্ষতা বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত।

৫. স্কুল খাওয়ানো কর্মসূচি: শিশুদের অপুষ্টি মোকাবিলা এবং স্কুলে উপস্থিতি উৎসাহিত করতে সরকার অনেক গ্রামীণ এবং সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে স্কুল খাওয়ানোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।

৬. অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কর্মসূচি: বিভিন্ন কর্মসূচির লক্ষ্য প্রতিবন্ধী শিশুদের মূলধারার শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং সংস্থান প্রদান করা।

৭. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়ন, উদ্ভাবনী শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রবর্তন এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা উৎসাহিত করা হয়েছে।

৮. শিক্ষক প্রণোদনা কর্মসূচি: গুণগতমানের শিক্ষক আকর্ষণ এবং ধরে রাখার জন্য সরকার প্রণোদনা কর্মসূচি চালু করেছে, যার মধ্যে আর্থিক পুরস্কার, পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ এবং আরও ভাল কাজের পরিবেশ অন্তর্ভুক্ত।

শেষ কথা

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়েছে, ভর্তির হার এবং লিঙ্গ সমতায় উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জন করেছে। তবে, সবার জন্য উচ্চমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গুণগতমান, সমতা এবং অবকাঠামোর সমস্যা সমাধান করা শিক্ষা খাতের অব্যাহত উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুষ্ঠু প্রচেষ্টা এবং কৌশলগত বিনিয়োগের মাধ্যমে, বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে যা তার নাগরিকদের ক্ষমতায়ন করে এবং দেশের অগ্রগতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতিশীল, যদি দেশটি কার্যকরভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করতে পারে। ধারাবাহিক উন্নতি, উদ্ভাবন এবং অন্তর্ভুক্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলে, বাংলাদেশ তার তরুণ জনগোষ্ঠীকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞান সরবরাহ করতে পারে। শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি, এবং নিবেদিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, বাংলাদেশ তার সকল নাগরিকের জন্য একটি উজ্জ্বল, সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।

2 Comments

  • আর্টিকেল টি ভাল হয়েছে

  • The story brings up intriguing ideas. I’ve been following
    this topic for a while, and it’s fascinating to see
    how it’s evolving. Appreciate the thorough reporting.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *